গাড়ির স্টেশন বদরখালী নাকি মহেশখালী অংশে !
কাব্য সৌরভ
স্টেশন কোথায় থাকবে আর কোথায় থাকবে না– সেটা নিশ্চিত করবে ওই স্টেশনের সুবিধাভোগীরা, মানে চালক আর যাত্রী। মহেশখালীর যাত্রী ও চালক কোথায় নিরাপদবোধ করবে সেটা বদরখালী ঠিক করে দিতে পারে না। যদি এটি হয় তা হবে বলপ্রয়োগে বৈষম্য। এতে বদরখালী মহেশখালীর মানুষের শতবছরের সম্পর্কে ফাটল ধরবে, যা উভয় এলাকার মানুষের কারো জন্য কল্যাণকর হবে না।
মহেশখালীর প্রান্তে স্টেশন স্থাপন ও স্থায়ীকরণে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে চালকদের গণস্বাক্ষর। মহেশখালীর চালক ও যাত্রীর নিরাপত্তা জন্য চালকদের গণস্বাক্ষর নিয়ে স্থানীয় ইউএনও, জেলা প্রশাসক, বাংলাদেশ রোড় ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বরাবর স্মারকলিপি দিতে হবে। এটি মহেশখালীর নেতৃত্ব শ্রেণির কাউকে এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে কেউ করবে না। যতটুকু জানি মহেশখালীর সিএনজি চালকরা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়, হলে– তারা দায়িত্ব নিয়ে করতে পারে।
স্টেশন চালিয়াতলী অথবা ব্রিজের পশ্চিম পাশে স্থায়ী করতে গেলে তার পাশাপাশি চকরিয়া, বাঁশখালী, পেকুয়া, চট্টগ্রামের সিএনজিকে চালিয়াতলী অথবা ব্রিজের পশ্চিমে আসার ব্যবস্থা এবং স্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি চকরিয়া, বাঁশখালী, পেকুয়া, চট্টগ্রামের সিএনজি সমিতির সাথে কথা বলে ঠিক করতে হবে।
যদি সেটা করা না যায়, রামু টু কক্সবাজার সার্ভিসের মতো চালিয়াতলী বা স্টেশন টু চকরিয়ার জন্য মিনিবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটাও ওই বাস সমিতির সাথে কথা বলে ঠিক করতে হবে।
যদি এটাও সম্ভব না হয়, মহেশখালীর সিএনজি লাইনকে চকরিয়া, চট্টগ্রাম লাইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অথবা মহেশখালীর বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও গাড়ি মালিককে উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের গাড়ি এই রোডে দিতে হবে।
বদরখালী বাজার টু মহেশখালী স্টেশন অটোরিকশা (টমটম) নির্দিষ্ট করতে হবে। যে অটোগুলো বাজার কিংবা ফেরিঘাট থেকে যাত্রী আনবে তারা স্টেশন পর্যন্ত এসে যাত্রী নামিয়ে দিবে। বর্তমানে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা এই ইস্যু ধরেই। একই অটো স্টেশন থেকে যাত্রী ফেরিঘাট বা বদরখালী বাজারে নিয়ে যাবে।
জনতা বাজার ঘাট অথবা শাপলাপুর জেএম ঘাট থেকে স্পিডবোটে কক্সবাজারের খুরুশকুলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কালারমারছড়া, শাপলাপুর, মাতারবাড়ি, হোয়ানক, ধলঘাটাসহ পাঁচ ইউনিয়নের কক্সবাজারমুখি যাত্রীদের নিয়ে মাত্র ১০ টা স্পিডবোট দিয়ে স্বল্প খরচে এই নৌ-রুট চালু করা যায়।
স্টেশন স্থাপনে সমস্যা যেটি– ব্রিজ ওয়ালারা চায় স্টেশন বদরখালী প্রান্তে হোক। গাড়ি ব্রিজ পার হলে ব্রিজ ওয়ালারা টাকা পায়। স্টেশন বদরখালী প্রান্তে রাখার জন্য সিএনজি, অটোরিকশা মালিক সমিতিকে তারা মাসিক মাসোহারা দেয় বলে কথিত রয়েছে।
চালকরা সহজসরল, তাদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করে বিশৃঙ্খলা বাঁধানোর পাঁয়তারা হবে। বড়সড় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে স্টেশন বদরখালীতে করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করা হবে একাধিক পক্ষ থেকে।
শেষমেশ এখানে প্রশাসনের বাহিনী ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু গণঐক্য, গণদাবির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কোনো প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা প্রত্যেক নাগরিক তার নিরাপত্তার অধিকার রাখে। চালক যাত্রীরা যেখানে নিরাপদ মনে করবে সেখানে স্টেশন হবে।
স্টেশন ব্রিজের পশ্চিম পাশে অথবা চালিয়াতলী যেখানেই হোক, সেখানে স্থানীয় মানুষদের সহনশীল বিনয়ী হতে হবে। তারা যেন কোনোভাবে চালকদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না করে। বিষয়টি স্থানীয় নেতৃত্ব শ্রেণিসহ সকলকে দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত করতে হবে।
মালিক সমিতির বাইরে চালকদের স্বার্থ, নিরাপত্তা, অধিকার রক্ষায় ড্রাইভারদের নিয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন বা সমিতি করতে হবে। এতে করে স্টেশন হস্তান্তর করে কারো প্ররোচনায় মালিক সমিতি সকল চালকের অধিকার বিক্রি করে দিতে পারবে না।
স্টেশন স্থাপন, চালক যাত্রীর নিরাপত্তা, কেউ বিশৃঙ্খলা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মহেশখালীর ইউএনও মহোদয়কে অবগত করতে হবে। এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
শুধু স্টেশন নয়, বাজার পরিবর্তন দরকার– স্টেশন হলে বাজার আপনা-আপনি হয়ে যাবে। এটার জন্য চালিয়াতলীতে কাঁচাবাজার স্থাপন করতে হবে।
মানুষ পান বিক্রি করে যেহেতু, বদরখালী বাজার থেকে সবজিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয় করে তার জন্য চালিয়াতলীর পানবাজার শুক্রবারের পরিবর্তে একদিন আগে বৃহস্পতিবার এবং একইভাবে মঙ্গলবারের পরিবর্তে সোমবার করতে হবে।
একই দিন কাঁচাবাজারের আড়তদার আনার ব্যবস্থা করতে হবে, অথবা মহেশখালীর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাঁচাবাজারের আড়তদারের ভূমিকা পালন করতে হবে।
মহেশখালীর মানুষেরা বদরখালী যায় মূলত সেখানকার পাইকারি বাজারের সুবিধা নিতে। সেই বাজারটি টিকে আছে মূলত মহেশখালীর পাঁচ ইউনিয়নের প্রায় ৩ লক্ষ মানুষের উপর নির্ভর করে। খেয়াল করেন জনতা বাজার চালু থাকার সময়ে মহেশখালীর মানুষ বদরখালীর উপর অতটা নির্ভর ছিল না। বদরখালীর উপর নির্ভরতা কমাতে হলে এই রকম একটি পাইকারি বাজার মহেশখালীতে প্রতিষ্ঠা করার কোন বিকল্প নাই।
এজন্য দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত মহেশখালীর মানুষকে বদরখালী থেকে বাজার করা কিছু দিনের জন্য নিরুৎসাহিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত মহেশখালীর অংশে অস্থায়ী বা ছোট পরিসরে (বিশেষ করে কাঁচা শাক সবজির) বাজার বসার একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এতে দুটি ফল হবে। প্রথমত বাজার চালু হলে ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হবে এবং বাজারটি স্থায়ী হয়ে উঠবে। দ্বিতীয়ত কাস্টমার সংকট দেখা দিলে বদরখালীর ব্যবসায়ী মহেশখালীর বাজারে এসে হাট বসাবে।
বাজার কেন্দ্রিক বদরখালীর উপর নির্ভরতা কমানো না গেলে শুধু গাড়ির স্টেশন স্থানান্তর করে সুফল পাওয়া যাবে না।
গণধর্ষণের বিষয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে বদরখালীর মানুষের ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে মামলার অবস্থা অনেকেই জানেন। একইভাবে বদরখালীর কেউ মহেশখালীতে ধর্ষণের শিকার হলে দোষীদের বিরুদ্ধে মহেশখালীর মানুষেরও একই ভূমিকা থাকতো।
বদরখালী স্টেশনে মহেশখালীর চালক যাত্রী নানাভাবে মারধর, হেনস্তা, ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে এটি নিতান্ত সত্য। এখানে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বদরখালীর মানুষ ব্যর্থ হয়েছে।
নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চালক-যাত্রী মহেশখালীতে স্টেশন করলে এতে যদি বদরখালীর কিছু মানুষ বিশৃঙ্খলা করে তাহলে একটি ইউনিয়নের সাথে একটি উপজেলার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে।
৬ জানুয়ারি যেমন ২৫ কিলো দূরের গোরকঘাটা থেকে এসে বদরখালীর ফেরিঘাটে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলো মহেশখালীর ছাত্রজনতা–কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকার শহিদ মিনারে মহেশখালীর সন্তানরা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, একইভাবে তখনও দাঁড়িয়ে যাবে। কারণ এটি বাপদাদার প্রজন্ম নয়, ২৪'র তারুণ্যের প্রজন্ম।
স্টেশন, বাজার নিয়ে বিশৃঙ্খলা হলে তখন বদরখালীর এক ইউনিয়নের ৮০ হাজার মানুষ কথা বলবে, বিপরীতে মহেশখালীর ৬ লাখ মানুষ আওয়াজ তুলবে।
বদরখালীর মানুষের সাথে মহেশখালীর মানুষের শতবছরের সম্পর্ক, এতে ফাটল ধরবে। বদরখালীর অধিকাংশ মানুষের জমি মহেশখালীর প্রান্তে ওসব আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
মহেশখালীর পাঁচ ইউনিয়নের প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ বদরখালী বাজারের উপর নির্ভরশীল, এই নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে বাজার ও স্টেশন স্থাপন করতে হবে– আজ অথবা কাল। নয়তো আগামীতে আরো অনিরাপত্তা ও হেনস্তা, তাচ্ছিল্যের শিকার হবেন।
কালারমার ছড়া, মাতারবাড়ি, ধলঘাটা, হোয়ানক, শাপলাপুর পাঁচ ইউনিয়নসহ মহেশখালীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের আশাবাদী নেতারা এই বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে কথা বলুন, ব্যবস্থা নিন। উপরে প্রতিবাদ দেখিয়ে ভিতরে নেতিয়ে পড়লে আপনিও মাইনাসের কাতারে পড়ে যাবেন।
চালিয়াতলীতে বাজার ও স্টেশন হলে সেখানকার নেতৃত্ব শ্রেণির স্থানীয়দের দায়িত্ব নিয়ে সকলকে সহনশীল বিনয়ী উদার হতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বটা তরুণদের নিতে হবে। চালিয়াতলীতে মহেশখালীসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ রয়েছে। তারা যদি উচ্ছৃঙ্খল, বাজে, এবং অনুদার হয়ে নতুন বদরখালী হয়ে উঠে তাহলে ঘুরেফিরে একই কথা। এটি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
মহেশখালীর নেতা, নেতৃত্বশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক, সচেতন তরুণদের এই বিষয়ে আন্তরিকভাবে এক হতে হবে। এখনো পর্যন্ত তেমন কাউকে দেখিনি, অথবা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি।
–লেখাটা দীর্ঘ হওয়ার জন্য বিনয়াবনত দুঃখিত, যে-কেউ যৌক্তিক মতামত অথবা সমালোচনা করতে পারেন।
লেখক: কাব্য সৌরভ, মহেশখালীতে কর্মরত সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।